-->
সত্যজিৎ রায়

সত্যজিৎ রায়




সত্যজিৎ রায়





Satyajit as a cameraman

সত্যজিৎ রায়ের জন্ম 1921 সালের 2 রা মে । বিশ্ববরেণ্য জাপানি চলচ্চিত্রের পরিচালক আকিরা কুরোসাওয়া তার সম্পর্কে বলেছিলেন “এ পৃথিবীতে বাস করে সত্যজিৎ রায়ের ছবি না দেখা, চন্দ্র-সূর্য না দেখার মতোই অদ্ভুত ঘটনা” । রবীন্দ্রনাথের পর বাংলা সংস্কৃতির জগতের কেউ যদি বিশ্বের দরবারে এতখানি সম্মান পেয়েছিলেন তাহলে তিনি হচ্ছেন সত্যজিৎ রায় ।



With his family

সংস্কৃতির ক্ষেত্রে একমাত্র ঠাকুর পরিবারের সঙ্গেই এই পরিবারের তুলনা করা যায় । সত্যজিতের পিতামহ উপেন্দ্রকিশোর ছিলেন বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রষ্ঠা । সাহিত্য ছাড়াও বাংলা ছাপাখানার উন্নতির ক্ষেত্রে তার অবদান কম ছিল না । 1900 সালে তিনি সুকিয়া স্ট্রিটের বাড়িতে ইউ রায় এন্ড সন্স নামে একটি ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করেন । এখান থেকে বহু বই প্রকাশিত হয়েছিল ।
  উপেন্দ্রকিশোরের বড় ভাই সারদারঞ্জন ছিলেন পন্ডিত মানুষ, আর ক্রিকেটের ভক্ত । আরেক ভাই কুলদারঞ্জন ছিলেন সাহিত্যিক । তার কন্যা বিখ্যাত সাহিত্যিক লীলা মজুমদার । উপেন্দ্রকিশোরের পুত্র সুকুমার রায়ের জন্ম 1887 সালে । মাত্র আট বছর বয়স থেকেই শুরু হয় তার ছবি আঁকা, কবিতা লেখা । 1913 সালে উপেন্দ্রকিশোর সন্দেম পত্রিকা চালু করার পর, সুকুমার সেখানে নিয়মিত লিখতেন । 1914 সালে সুকুমারের বিয়ে হল ঢাকার বিখ্যাত সমাজসেবক কালীনারায়ন গুপ্তের নাতনি সুপ্রভাত সাথে । বিবাহের সাত বছর পর জন্ম হয় সত্যজিতের । 1923 সালে, সাত্যজিত যখন 2 বছরের শিশু, মাত্র 36 বছর বয়সে মারা গেলেন বাবা সুকুমার । স্বল্প জীবনকালেই তিনি রচনা করেছেন আবোল তাবোল, হ য ব র ল, ও পাগলা দাশু র মতন অসাধারণ শিশুসাহিত্য ।
সুকুমারের এই অকাল মৃত্যু নিয়ে এলো সংসারে এক বিরাট আঘাত । কয়েক বছরেই বাড়ি ছাড়তে হল তাদেরকে । সত্যজিৎ মায়ের সাথে এসে উঠলেন মামার বাড়িতে । বাবা না থাকলেও কোনদিন আর্থিক কষ্ট পাননি সত্যজিৎ । মামার বাড়িতে থাকার সময়েই তার সংগীতের প্রতি অনুরাগ জন্মায় । এই আনুরাগ তিনি উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছিলেন পিতা-পিতামহের কাছ থেকে ।
  1940 সালে বিএ পাস করলেন সত্যজিৎ । রবীন্দ্রনাথ খুবই স্নেহ করতেন সত্যজিৎকে । প্রধানত তাঁর আগ্রহেই ভর্তি হলেন শান্তিনিকেতনের শিল্প বিভাগে । এখানে নন্দলাল বসুর কাছে ছবি আঁকা তালিম নিয়েছেন । এক বছর পর তিনি ফিরে এলেন কলকাতায় । বাড়িতে বিধবা মা অন্যের উপর নির্ভর করে আর কতদিন জীবন ধারণ করবেন । তখন 1943 সালে ডি. জে. কীমার নামে একটি বিজ্ঞাপন সংস্থায় চাকরি করলেন ।
যখন তিনি কীমারে চাকরি করতেন সেই সময় বাংলা চলচ্চিত্রের মান ছিল নিত্যান্তই সাধারন । প্রথম থেকেই সত্যজিতের সাথে পরিচয় হলো বংশী চন্দ্রগুপ্ত নামে এক তরুণ শিল্পীর সাথে । বংশী ছিলেন কাশ্মীরের ছেলে । সিনেমার প্রতি তার ছিল গভীর আগ্রহ । দুজনের মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে উঠল ।আমৃত্যু তিনি ছিলেন সত্যজিতের প্রতিটি ছবির শিল্পনির্দেশক । দুজন মিলে স্থির করে রবীন্দ্রনাথের ঘরে বাইরে উপন্যাসটি কে সিনেমা করেছিলেন । বিভূতিভূষণের পথের পাঁচালী ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হয়েছিল । সিগ্সনেট প্রেস তা বই হিসাবে প্রকাশ করে । এই বই এর জন্য ছবি এঁকেছিলেন সত্যজিৎ । পথের পাঁচালী তার মনকে এত গভীরভাবে নাড়া দিয়েছিল, সম্ভবত সেই সময়েই পথের পাঁচালী নিয়ে ছবি করার কথা ভাবেন ।
1948 সালে সত্যজিৎ তার মায়ের বৈমাত্রেয় ভাই চারুচন্দ্রের ছোট মেয়ে বিজয়া কে বিয়ে করলেন । দুজনেই পরস্পরকে ভালোবাসতেন । শুধুমাত্র পুত্রের সুখের কথা ভেবেই সুপ্রভা দেবি এই বিবাহে মত দিলেন । চাকরি সুত্রে কয়েক মাসের জন্য ইংল্যান্ডে গেলেন সত্যজিৎ । ইউরোপ-আমেরিকার শ্রেষ্ঠ পরিচালকদের অসংখ্য ছবি দেখতেন তিনি। এবং তা গভীরভাবে অনুভব করার চেষ্টা করতেন । ভারতে ফিরে এসে স্থির করলেন পথের পাঁচালী ছবি করবেন ।
ছবি তৈরির নানা সমস্যা । কয়েকজন সহযোগী পেলেন সত্যজিৎ , তাদের মধ্যে ছিলেন বংশী চন্দ্রগুপ্ত , ক্যামেরাম্যান সুব্রত মিত্র, দুলাল দত্ত আরও অনেকে । মূল সমস্যা দেখা দিল অর্থের । সত্যজিৎ জীবন বিমা থেকে সাত হাজার টাকা ধার করলেন । নিজে কিছু টাকা জোগাড় করলেন । এই ছবির চরিত্রের জন্য যাদেরকে নির্বাচন করলেন তাঁরা কেওই পেশাদার অভিনেতা নয় । মানুষকে দেখে তার ভেতরে প্রতিভা কে চিনে নেবার আশ্চর্য ক্ষমতা ছিল সত্যজিতের । তাছাড়া মানুষের ভেতরের সুপ্ত ক্ষমতা কে বাইরে আনবার সহজাত দক্ষতাও ছিল তার । তাই তার হাতেই পরবর্তীকালে জন্ম নিয়েছিল একাধিক বিখ্যাত অভিনেতা অভিনেত্রী ।
সামান্য যন্ত্রপাতি সামান্য আয়োজন । সাধারণ অভিনেতা-অভিনেত্রী, তাই নিয়েই পথের পাঁচালীর কাজ শুরু করা হল । কিছুটা কাজ হওয়ার পর যা অর্থ ছিল সব শেষ হয়ে গেল । স্ত্রী বিজয়ার গহনা বন্ধক দিলেন । নিজের কিছু দামি বই বিক্রি করে দিলেন । তাতেও কাজ খুব বেশি এগোল না । একজন নতুন পরিচালক কেউ কোনো অর্থ সাহায্য করতে চাইছিলো না ।
সত্যজিতের মায়ের এক বন্ধুর সাথে বিধান রায়ের পরিচয় ছিল । সেই সুত্রেই সত্যজিৎ তাকে পথের পাঁচালীর কিছুটা অংশ দেখালেন । পথের পাঁচালী বিধান রায়ের ভালো লেগেছিল । তিনি সেখানে পথের পাঁচালী পাঠাবার জন্য অনুরোধ করলেন । সকলের আন্তরিক প্রচেষ্টায় শেষ পর্যন্ত ছবি শেষ হলো । বাক্সবন্দী পথের পাঁচালী ছবি পাঠানো হলো আমেরিকায় ।
1955 সালে পথের পাঁচালী কলকাতার বসুশ্রি সিনেমা হলে মুক্তি পেল । প্রযোজক পশ্চিমবঙ্গ সরকার । প্রথমদিকে দর্শকরা এই ছবিটিকে গ্রহণ করতে না পারলেও কয়েক সপ্তাহ পর থেকেই চারিদিকে সত্যজিতের প্রশংসা ছড়িয়ে পড়ল । জনসাধারণের ভিড় বাড়তে থাকে ।
এর মুলে ছিল পথের পাঁচালী অসাধারণত্ব। বিভূতিভূষণের উপন্যাসের মুল সুরটিকে এক আশ্চর্য দক্ষতাই ছবির পর্দায় ফুটিয়ে তুলেছিলেন সত্যজিৎ । প্রত্যেকের অভিনয় ছিল জবন্ত আর সজিব । এর সাথে ছিল রবিসঙ্করের অসাধারণ সংগীত । তিনিি প্রথম দেখালেন চলচ্চিত্রে সঙ্গীতের কত সার্থক প্রয়োগ ঘটানো সম্ভব । প্রকিতপক্ষে পথের পাঁচালীর মধ্যে দিয়ে সত্যজিৎ চলচ্চিত্রে এক নতুন যুগের সূচনা করেছিলেন ।
1956 সালের কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে শ্রেষ্ঠ ছবির পুরস্কার পেল পথের পাঁচালী। তারপর দেশ-বিদেশে একের পর এক পুরস্কার । এক অখ্যাত বাঙালি তরুন শুধুমাত্র একটি ছবি করেই জগদ্বিখ্যাত হয়ে গেলেন । পথের পাঁচালী শুধু একটি ছবি নয়, গভির প্রশান্ত সৌন্দর্যে উদ্ভাসিত এক তুলনাহিন সৃষ্টি, যা দেশ কাল উত্তীর্ণ হয়ে মানুষ কে আবিভুত করে । সে কারণেই জহরলাল বলেছিলেন, “সত্যজিৎ রায় আর তার ছবি পথের পাঁচালী আমাদের গর্ব।”
পথের পাঁচালীর সাফল্যে উৎসাহিত হয়ে সত্যজিৎ তৈরি করলেন অপরাজিতা। অপু ট্রিলজির দ্বিতীয় ছবি । অপুর কৈশোর জীবনের কাহিনী। অপরাজিতা সাধারণ দর্শকরা গ্রহণ করতে না পারলেও ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবে পেল শ্রেষ্ঠ পুরস্কার গোল্ডেন লায়ন।



Directing his Stars


  এরপর সত্যজিৎ তৈরি করলেন অপু ট্রিলজির শেষ ছবি অপুর সংসার । এই ছবিতে নিয়ে এলেন তরুণ সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় আর 14 বছরের কিশোরী শর্মিলা ঠাকুর কে। লন্ডন ফিল্ম ফেস্টিভেলে অপুর সংসারকে দেওয়া হল শ্রেষ্ঠ পুরস্কার।বিশ্বের চলচ্চিত্রের ইতিহাসে এই ট্রিলজির কোন তুলনা নেই। মহান সাহিত্য স্রষ্টাদের সৃষ্টির সাথেই এর তুলনা করা যায়।
অপরাজিতা ছবি মুক্তি পায় 1956 সালে। এই ছবি ব্যবসায়িক সাফল্য না পাওয়ার জন্য সত্যজিৎ অপুর সংসারের আগে দুটি ছোট ছোট ছবি তৈরি করেন – পরশপাথর আর জলসাঘর। জলসাঘর তারাশঙ্করের একটি ছোটগল্প। দুটি ছবিতেই সত্যজিতের প্রতিভার পূর্ণ বিকাশ ঘটেছে।
এরপর দেবি। হিন্দুদের প্রচলিত বিশ্বাস আর কুসংস্কারের বিরুদ্ধে তীব্র আঘাত হানলেন সত্যজিৎ । এক শ্রেণীর মানুষ এই ছবির মুক্তির ব্যাপারে তীব্র বিরোধিতা প্রকাশ করতে থাকে। শেষ পর্যন্ত জহরলালের হস্তক্ষেপে এই ছবি মুক্তি পেল। প্রখ্যাত চলচ্চিত্র সমালোচক রবার্ট ষ্টীল লিখেছেন সত্যজিৎ রায় তার সিনেমির জীবন শুরুই করেছেন মাস্টারপিস ছবি দিয়ে। যদি অপু সৃষ্টি না হতো তবে দেবীকে সেই সম্মান দেওয়া হতো। দেবি সত্যজিতের সবচেয়ে প্রাঞ্জল আর সরল ছবি। এর মধ্যে আছে এক আবেগের গভীরতা আর সৌন্দর্য যা তুলনাহীন।
রবীন্দ্রকাব্য সত্যজিৎকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। রবীন্দ্রনাথের তিন টি ছোটগল্প অবলম্বনে তৈরি করলেন তিন কন্যা, মনিহারা, পোস্টমাস্টার আর সমাপ্তি। মেলবোর্ন ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে শ্রেষ্ঠ পুরস্কার পেলো তিন কন্যা। সমাপ্তি গল্পেই প্রথম অভিনয় করলেন অপর্ণা।
এরপর থেকে একে একে মুক্তি পেতে থাকে কাঞ্চনজঙ্ঘা, অভিযান, মহানগর, চারুলতা, কাপুরুষ ও মহাপুরুষ, নায়ক। নায়ক সত্যজিতের এক সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী ছবি। এক বিখ্যাত অভিনেতার জীবন যন্ত্রণার কাহিনী।
1968/69 সালে দাদু উপেন্দ্রকিশোরের কাহিনী অবলম্বন করে তৈরি করলেন ছোটদের ছবি গুপী গাইন বাঘা বাইন। এযাবৎ সত্যজিতের কন ছবিই এ দেশে বাণিজ্যিকভাবে তেমন সফল হয়নি। কিন্তু গুপি গাইন বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। রূপকথার কাহিনী অবলম্বন করে এক আশ্চর্য সুন্দর ছবি তৈরি করেছিলেন।এই ছবিতে সত্যজিতের প্রতিভার আরেকটি দিক উন্মোচিত হলো। সঙ্গিত সম্বন্ধে সত্যজিতের ছোটবেলা থেকেই ছিল গভীর আগ্রহ। প্রথম কয়েকটি ছবিতে রবিশঙ্কর, ওস্তাদ বিলায়েৎ খান, আলি আকবর সঙ্গীত পরিচালনা করলেও তারপর থেকে নিজেই সংগীত পরিচালনা করতে থাকেন । অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা ছিল আবহ সংগীত।কিন্তু গুপি গাইন এর উনিশটি গান তিনি নিজেই রচনা করেছিলেন। প্রতিভা চেনবার কতখানি ক্ষমতা ছিল তা বোঝা যায়, যখন সম্পূর্ণ অপরিচিত নায়ক আনুপ ঘোষাল কে নিয়ে তিনি শিল্পী হিসেবে জনপ্রিয়তা লাভ করেছিলেন, কোন মানুষেরই তা অজানা নয়।
  বহু মানুষের ধারণা বাস্তব সমাজ জীবন সম্বন্ধে সত্যজিৎ ছিলেন উদাসীন। এই ধারণা যে কতখানি ভ্রান্ত তার প্রমাণ পাওয়া যায় প্রতিদ্বন্দ্বি, জন-আরণ্য ছবিতে। সমাজ জীবনের নানান পঙ্কিলতা, বেকার সমস্যা, তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক অস্থিরতাকে নিপুণ দক্ষতায় ফুটিয়ে তুলেছিলেন ছবিতে। কিন্তু কোথাও তা প্রচারধর্মী হয়ে ওঠেনি। তাছাড়া সত্যজিতের ছবির আরেকটি বৈশিষ্ট্য তিনি সব যন্ত্রণা,হতাশ,পাপ,অন্যায়ের মধ্যেও ছিলেন আশাবাদী।



How to take Angels

পথের পাঁচালী পর গ্রাম্য জীবন নিয়ে দ্বিতীয় ছবি করেন বিভূতিভূষণের কাহিনী অবলম্বনে অশনিসংকেত। 43-এর মন্বন্তর কিভাবে গ্রামের সহজ-সরল জীবনকে ধ্বংস করে নিয়ে এলো দুর্ভিক্ষ, মহামারী আর ব্যাভিচার, তারই এক জীবন্ত চিত্র। এই ছবির কোন চরিত্রকেই মনে হয়নি তারা অভিনয় করছে। সকলেই যেন জীবনের পা থেকে উঠে এসেছে। দুর্ভিক্ষের উপর এমন ছবি বিশ্বে খুবই কম তৈরি হয়েছিল। বার্লিন, শিকাগো দুটি চলচ্চিত্র উৎসবেই অশনি সংকেত পেয়েছিল সর্বশ্রেষ্ঠ ছবির পুরস্কার। মুন্সি প্রেমচাঁদ এর কাহিনী অবলম্বনে প্রথম হিন্দি ছবি করলেন শতরঞ্জকে খিলাড়ী । দুই বিরাসি মরাহ সমাজ সংসার ভুলে দাবা খেলায় মত্ত হয়ে থাকে। অন্যদিকে ইংরেজরা রাজনৈতিক চালে এক একটি রাজ্য দখল করতে থাকে। নিতান্ত সাধারণ কাহিনী, ঘটনার ঘনঘটা নেই। কিন্তু প্রতিভার স্পর্শে অসাধারণ ছবি হয়ে উঠেছে এই শতরঞ্জকে খিলাড়ী ।
সাত্যাজিতের ছবির আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো অতি সামান্য বিষয়ও জাতে নিখুত হয় সেদিকে ছিল তার সতর্ক দৃষ্টি। সেই কারনে স্যার রিচার্ড অ্যাটনবরো বলেছিলেন, “সাত্যজিতের যে জিনিসটি আমাকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করেছিল তা প্রতিটি বিষয়ের প্রতি তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। একমাত্র চ্যাপলিন ছাড়া আর কোনো পরিচালকের সাত্যাজিতের মত সিনেমা পরিচালনার ব্যাপারে সকল বিষয়ে প্রতিভা আছে কিনা সন্দেহ।”
নিজেরই কাহিনী অবলম্বন করে সাত্যাজিত তৈরি করেছিলেন দুটি গয়েন্দা ছবি সোনার কেল্লা আর জয় বাবা ফেলুনাথ। নিছক গয়েন্দা লোমহর্ষক ঘটনার মধ্যে তিনি কাহিনি কে সীমাবদ্ধ রাখেননি। মনমুগ্ধকর অপূর্ব প্রাকৃতিক দৃশ্যের সাথে যুক্ত করেছিলেন হাসি আর হেঁয়ালি। ছোটদের জন্য এত সুন্দর গোয়েন্দা কাহিনী খুব কমই তৈরি হয়েছে।
সাত্যাজিত যখন ডি. জে. কীমারে চাকরি করতেন তখনই তার মনে হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের ঘরে বাইরে অবলম্বনে ছবি করবেন। কিন্তু সেই সময় তার ইচ্ছা পূর্ণ হয়নি। অবশেষে 1984 সালে তৈরি করলেন ঘরে বাইরে। রবীন্দ্ররচনার মুল সুরটিকে এত নিপুণভাবে সাত্যাজিত তার ছবিতে তুলে ধরেছেন যা আর অন্য কোনো পরিচালকের পক্ষে সম্ভব হয়নি।
ক্রমশয় তার স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ছিল। ঘরে-বাইরের পর বেশ কয়েক বছর কোন ছবি করেননি। 1989 সালে ইবসেনের কাহিনি অবলম্বনে তৈরি করেছিলেন গনশত্রু, তারপর শাখা-প্রশাখা, শেষ ছবি আগন্তুক।
চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবে সাত্যাজিতের স্থান পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কয়েকজন পরিচালকদের মধ্যে। তার ছবিতে যে গভীর সূক্ষ্ম অনুভূতি, নান্দনিক সৌন্দর্য, জিবনের ব্যাপ্তি, বিষয়বস্তুর প্রতি নিষ্ঠার প্রকাশ দেখতে পাওয়া যায় তা তুলনাহীন। শ্রেষ্ঠ ছবি জেন সঙ্গীত, শ্রেষ্ঠ কবির কবিতা। যত বার দেখা যাই ততবারই উম্মচন হয় নতুন সৌন্দর্য , মনের জগতে উম্মচিত করে নতুন দিগন্ত। যার মধ্যে আমরা আমাদেরই খুঁজে পায়।
চলচ্চিত্র পরিচালক সাত্যজিতের খ্যাতি জগৎজোড়া হলেও সাহিত্য স্রষ্টা হিসাবে তার খ্যাতি কিছুমাত্র কম নয়। তার পিতা পিতামহের ঐতিহ্য অনুসরনে তিনি নানান বিষয় নিয়ে লিখতেন। তাদের পারিবারিক পত্রিকা চালু হল। এই পত্রিকার জন্য নিজেই কলম ধরলেন সাত্যজিত। নিজে ছোট ছোট ছড়া লিখতেন। এবার লিখলেন ধারাবাহিক বিজ্ঞানভিত্তিক উপন্যাস প্রফেসর শঙ্কু। পরবর্তীকালে প্রফেসর শঙ্কুকে নিয়ে আরও কয়েকটি বই লিখেছেন। তবে সত্যজিতের আসল খ্যাতি তার ফেলুদাকে নিয়ে। শিশু-কিশোরদের কাছে ফেলুদার আকর্ষণ অতুলনীয়। গোয়েন্দা গল্পের গোয়েন্দা ফেলুদা তার স্রষ্টার মতই বিখ্যাত । সত্যজিতের গল্প বলার ভঙ্গি অসাধারণ। সহজ সরল ভাষা , কাহিনির নিটোল বুনন, অপূর্ব বর্ণনা, টানটান উত্তেজনা পাঠক কে শেষ পর্যন্ত মুগ্ধ করে রাখে। তার রচনা চিরায়ত সাহিত্যের পর্যায়ে না পড়লেও দীর্ঘদিন পর্যন্ত পাঠকের মনোরঞ্জন করতে পারবে সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।



Advisor Satyajit

ফেলুদা, শঙ্কু ছাড়াও সত্যজিৎ বেশ কিছু ছোট গল্প লিখেছেন যেমন এক ডজন গল্প, আরো এক ডজন, আরো বারো – এই বই গুলির প্রতিটি গল্পই যেমন উপভগ্য তেমনি সার্থক সৃষ্টি।
চলচ্চিত্র নিয়ে তাঁর প্রথম ইংরেজি বই ” Our Films their Films” বিশ্ব চলচ্চিত্র প্রসঙ্গে এক মূল্যবান সংযোজন । এতে একদিকে যেমন ফুটে উঠেছে তার সহজাত রসবোধ, অন্যদিকে গভির পান্দিত্য।



He knows how to make a film

তার আত্মজীবনী যখন “ছোট ছিলাম” খুবই উপভোগ্য। বিরাট প্রতিভার অধিকারী এই মানুষটি চিত্রশিল্পী হিসেবেও ছিলেন অসাধারণ। নিজের বই এর সমস্ত ছবি নিজেই আঁকতেন। তাছাড়াও বহু বিখ্যাত বইয়ের প্রচ্ছেদ তারই আঁকা।
অসামান্য কীর্তির জন্য অসংখ্য পুরস্কার পেয়েছেন সত্যজিৎ। পথের পাঁচালী দিয়ে 1956 সালে পান প্রথম আন্তর্জাতিক পুরস্কার আর তার পরিসমাপ্তি ঘটে 30শে মার্চ 1992 অস্কার পুরস্কার প্রদানের মাধ্যমে। এর মাঝে তিনি দেশ-বিদেশে অসংখ্য পুরস্কার পেয়েছেন, নানাভাবে সম্মানিত হয়েছেন। শ্রেষ্ঠ পরিচালনা, শ্রেষ্ঠ ছবির জন্য পুরস্কারের কথা বাদ দিলেও নানান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পেয়েছেন ডিলিট উপাধি। তার মধ্যে আছে অক্সফোর্ড, দিল্লি, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। শান্তিনিকেতন থেকে পেয়েছেন দেশিকোত্তম। 1985 সালে পেয়েছেন দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার। 1987 সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ফরাসী প্রেসিডেন্ট ফ্রাসোয়া মিতের কলকাতায় এসে সত্যজিৎকে দিলেন সে দেশের সর্বোচ্চ সম্মান ‘লিজিয়ন অব অনার’।এ এক দুর্লভ সম্মান জানিয়ে ফরাসি প্রেসিডেন্ট বলেছিলেন, “ভারতের সাংস্কৃতিক জগতে সত্যজিৎ রায় এক অবিস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব। চলচ্চিত্র জগৎ এ এই শতাব্দির শ্রেষ্ঠ পুরুষ। তার মতন মহান ব্যক্তিকে আমাদের দেশের সর্বোচ্চ সম্মান জানাতে পেরে আমি ও আমার দেশবাসী আজ কৃতজ্ঞ বোধ করছি।”



Oscar in his hand

জীবনের অন্তিম পর্বে এল হলিউডের সর্বোচ্চ সম্মান অস্কার। যা পৃথিবীর সব চলচ্চিত্র নির্মাতার কাছে চির আকাঙ্খিত বস্তু। তাকে এই পুরস্কার দেওয়ার জন্য অনুরোধ জানিয়েছিলেন বিশ্বের বিখ্যাত 70 জন মানুষ। এদের মধ্যে ছিলেন স্পিলবার্গ, কপোলো, নিউম্যান, জর্জ লুকাস, আকিরা কুরোসাওয়া। সত্যজিতের সমগ্র সৃষ্টিকে মূল্যায়ন করে তাকে দেওয়া হয় সম্মানিক অলংকার। তার আগের মাত্র পাঁচ জনকে এই পুরস্কার দেওয়া হয়- গ্রেটা গার্ব, চার্লি চ্যাপলিন, জেমস স্টুয়ার্ড, কুরসাওয়া। যখন অস্কার পুরস্কারের কথা ঘোষণা করা হলো সত্যজিৎ তখন অসুস্থ। বিছানায় শয্যাশায়ী। তিনি বলেছিলেন, “অস্কার পাওয়ার পর আমার পাওয়ার আর কিছুই রইল না।”
জীবনের সব পাওয়া শেষ হয়েগিয়েছিল। তাই পুরস্কার পাওয়ার মাত্র 23 দিন পর এই পার্থিব জীবন থেকে চিরবিদায় নিলেন সত্যজিৎ। দিনটা ছিল 1992 সালের 23 শে এপ্রিল।

0 Response to "সত্যজিৎ রায়"

Iklan Atas Artikel

Iklan Tengah Artikel 1

Iklan Tengah Artikel 2

Iklan Bawah Artikel